সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার মাদার বাজার এলাকার নয়টি গ্রাম নিয়ে নবগ্রাম। এই নবগ্রাম এর কাছে আমি বিভিন্নভাবে ঋণী। নবগ্রামের অনেক আলো—বাতাস আমি গায়ে মেখেছি। আজও সময় পেলেই ছুটি নবগ্রামে। নবগ্রাম আমাকে অন্যভাবে টানে। আমার মা মরহুমা আনোয়ারা’র জন্ম নবগ্রামে। অন্তিম শয়ানেও মা আছেন নবগ্রামে। নবগ্রাম হাজী মোঃ ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার কৈশোর—তারুণ্যের সোনালী দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। নবগ্রামের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে সর্বজনাব মোঃ আব্দুল মন্নান (যার স্মরণে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে দুই দুইটি স্মারকগ্রন্থ, খন্দকার গোলাম সোবহান (মরহুম), মোঃ আব্দুর রউফ (পরিণত বয়সে এসে ক’বছর ধরে যার সাথে আমার অন্যরকম সখ্য), ফজলুল হক (মরহুম), দীপক চন্দ্র দত্ত, রঙ্গেশ চন্দ্র দেব, সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী (পন্ডিত স্যার), মো. নজির মিয়া (মরহুম) আমার অন্তরে অম্লান হয়ে আছেন। নবগ্রামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন অথচ আমার সরাসরি শিক্ষক নয় এমন ক’জনের নামও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে, যাঁদের সান্নিধ্য ও স্নেহ আমাকে বিভিন্নভাবে উজ্জীবিত করেছে, তাঁরা হলেন— কাজী ফজলুর রহমান (মরহুম), সিরাজ উদ্দিন আহমদ (মরহুম), গোবিন্দ ভট্টাচার্য (প্রয়াত), মাও. আতিকুর রহমান, হাফিজ মেরাব উদ্দিন (মরহুম), হাফিজ ফজলুর রহমান (মরহুম), মাও. নছিরউদ্দিন আহমদ (মরহুম), মাও. কুতুব উদ্দিন আহমদ (মরহুম) ও মাও. আব্দুর রব (মরহুম)। এই সুযোগে আমার মরহুম শিক্ষকদের সাথে তাঁদেরও রূহের মাগফেরাত কামনা করছি।
এছাড়াও নবগ্রাম এলাকার বেশ ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্নেহ—সান্নিধ্যও আমার লাভ করার সুযোগ হয়েছে। নবগ্রামের উন্নয়নে যাদের অবদান স্মরণীয়; তাঁরা হলেন— আফতাবউদ্দিন আহমদ (মরহুম), যতীন্দ্র মোহন সোম (প্রয়াত, যাকে নিয়ে আমার সম্পাদনায় বেরিয়েছে ‘যতীন্দ্র মোহন সোম’ স্মারক), আব্দুল কাদির (মরহুম), হরমুজ আলী (মরহুম), আলহাজ্ব মছলন্দ আলী (মরহুম), তৈমুছ খান (মরহুম), সমছু মিয়া (মরহুম), মো: তাহির আলী মাস্টার (নবগ্রামের মাটি ও মানুষের লেখক), মো. নুরুল ইসলাম (ইংল্যান্ড প্রবাসী) প্রমুখ। বলাবাহুল্য, আমি আমার প্রথম বই “হৃদয়ে মম”তেও নবগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা বলেছি। চাঁন্দরগাও নিবাসী গণু মিয়ার চায়ের দোকানের কথাও আমার স্মৃতিতে উজ্জল হয়ে আছে। যেখানে আমার স্যারসহ নবগ্রামের বিশিষ্টজনরা নিয়মিত আড্ডা দিতেন। আমরাও ফাঁকে ফাঁকে সেখানে আসর জমাতে পছন্দ করতাম।
নবগ্রামে আমার সহপাঠীদের মধ্যে ফজির আহমেদ (আশরাফ), আতাউর রহমান মাখন, ফাতেহা বেগম, স্মৃতি রাণী দে ও মোঃ আব্দুল হান্নান (মরহুম) এর কথা ইদানিং খুব মনে পড়ছে। আশরাফ সুদূর আমেরিকায় থেকে নিরবে—নিভৃতে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, যার অসাম্প্রদায়িক ভাবনা ও কাজ আমাকে (এবং আমার ছেলে আনিসুল আলম নাহিদকে) মুগ্ধ করছে। মাখন অকালে পরকালে পাড়ি জমিয়েছে, কিন্তু তার বিনম্র ব্যবহার ও শালীনতা বোধ আমাকে আজও বিমোহিত করে। হাসি—খুশি প্রকৃতির আব্দুল হান্নান অবিবাহিত অবস্থায় নবগ্রামে শিক্ষকতাকালীন রোড এক্সিডেন্টে অকালে মারা গেছে। ফাতেহা ঘাতকদের হাতে স্বামী হারিয়ে ছেলে—মেয়ের কাছে আছে ইংল্যান্ডে। স্মৃতি মা—বাবা, ভাই—বোনের সাথে সেই আশির দশকে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। যাদের সাথে এ জীবনে আর দেখা—সাক্ষাতের আদৌ সম্ভাবনা নেই। কে কখন পাড়ি দিই পরপারে কে জানে! তবে পরিণত বয়সে এসে খুব ইচ্ছে করছে নবগ্রামের সব সহপাঠীদের নিয়ে একদিন বসার, সুখ—দু:খের কথা বলার, স্মৃতিচারণ করার, ভুল—ভ্রান্তির ক্ষমা চাওয়ার।
নবগ্রাম হাজী মো. ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়রদের মধ্যে বিচারপতি খিজির আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে গর্ববোধ করি। তাঁর সাথে ছিঁটে—ফোটা সম্পর্ক/যোগাযোগ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। যাঁর বাসা—বাড়িতে আমি একাধিকবার গিয়েছি, যাঁকে মদন মোহন কলেজে ও কোর্টে গিয়ে ডিস্টার্ব করেছি। তিনি প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যে আমার অনুরোধে আব্দুল মন্নান স্মারকগ্রন্থেও লিখেছেন। এছাড়া ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তা মো. মনফর আলীর কথাও বলা যায়। যার সাথে তুমি তুমি সম্পর্ক আপনি-তে উন্নীত হয়েছে। ১৯৮৭ সাল হতে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর আমরা একে অন্যকে আপনি আপনি করি।
নবগ্রামের আমার জুনিয়রদের মধ্যে কাজী হেলাল (যার হাত দিয়ে সাপ্তাহিক ‘বাংলার আলো’য় আমার অনেক গল্প—কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। যাকে নিয়ে আমি লিখেছি ‘কাজী হেলাল: সুরমার তীরে বেজে ওঠে কল্লোল ….’ এবং যাকে আমি আমার কবিতা ‘সবুজ শিল্পের প্রত্যয়’ উৎসর্গ করেছি। যে কবিতাটি “তিনকণ্ঠ” কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ), মুহম্মাদ বদরুজ্জামান (কলেজ শিক্ষক), শ্যামল কান্তি সোম (কবি—ছড়াকার), সামছি খানম চৌধুরী (আইনজীবি), মুহাম্মদ শরীফুজ্জামান (প্রধান সম্পাদক বালাগঞ্জ প্রতিদিন। যার হাত দিয়ে বিগত ক’বছরে বিচিত্র বিষয়ে আমার অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং যাকে ভবিষ্যতে আমার একটা বই উৎসর্গের কথাও ভাবছি) প্রমুখের নাম উচ্চারণ করতে আমার ভালো লাগে, যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নিজ কর্ম দক্ষতায়। এছাড়া নবগ্রামের তরুণ ও শক্তিশালী লেখকদের মধ্যে ইংল্যান্ড প্রবাসী সরওয়ার আলমের কথাও উল্লেখ করতে হয়। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড প্রবাসী এই লেখকের একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
নবগ্রামের কথায় মাদার বাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আরো দু’জন মানুষের কথা মাঝে মাঝে হৃদয়ে জাগে, তারা হলেন ডা. কানাই বাবু (ভালো নাম জানা নেই) এবং নার্স দিদি (নাম জানা নেই)। আত্মীয়—স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন চিরকুমারী সবার সেই দিদি ইউনিয়ন অফিসের একটা রুমে বসবাস করতেন, আর সুবল নামের বিড়ালকে কোলে—কাঁখে করে বেড়াতেন। বিড়ালটা মারা গেলে তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েন। বিগত শতকের আশি/নব্বই দশকে আমি সেই দিদি ও তার প্রিয় সুবলকে নিয়ে চমৎকার একটা গল্প লিখেছিলাম।
আমার লেখালেখির তথা সাহিত্য জীবনের শুরুও বলা যায় নবগ্রাম থেকে। নবগ্রাম এলাকায় বসবাসের সময় আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। নবগ্রাম হাজী মো. ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ পাঠাগার বলা যায় আমার সাহিত্য জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। আমাদের ছাত্রাবস্থায় মরহুম আব্দুল মন্নান (প্রধান শিক্ষক) এবং শ্রদ্ধেয় মো. আব্দুর রউফ (এটি স্যার)—এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় স্কুল লাইব্রেরিটি তখন সত্যি খুব সমৃদ্ধ ছিল। ক্রমান্বয়ে আমি স্কুল লাইব্রেরির সাহিত্যের প্রায় সবগুলো বই পড়ে ফেলি। যা পরবর্তীতে আমার সাহিত্য চর্চায় বেশ কাজে লাগে।
নবগ্রাম থেকে এসএসসি পাশের পরও আমি ক’বছর নবগ্রামে অবস্থান করি। সে সময় সমমনাদের নিয়ে গঠন করি তরুণ সাহিত্য পরিষদ। এ পরিষদ থেকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্য পত্র “প্রগতি”। খুব সম্ভব সেটা নবগ্রামের প্রথম কোনো সাহিত্য প্রকাশনা। “প্রগতি” বেশ কয়েক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আমার অনুরোধে গণ মানুষের কবি দিলওয়ার “প্রগতি”তে লিখেন চমৎকার সনেট—‘মাদার বাজারে প্রেম’। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সে ঐতিহাসিক কবিতা পরবর্তীতে আমি আমার সম্পাদিত শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা ‘আনোয়ারা’য় পুণ: মুদ্রিত করি। এ ছাড়া অন্যান্যদের সাথে “প্রগতি”তে লিখেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আব্দুল মন্নান (মরহুম), দীপক দত্ত ও মো: আব্দুর রউফ। নবগ্রাম থেকে আমার সম্পাদনায় দেয়াল পত্রিকা “স্মৃতি”ও কয়েক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। “স্মৃতি” লিখন ও অংকনে আমাকে সহযোগিতা করেন মাদার বাজার মাদ্রাসায় কর্মরত জকিগঞ্জ নিবাসী মাও. আতিকুর রহমান। “স্মৃতি”তে প্রকাশিত ‘অভিপ্রেত স্মৃতি’ কবিতায় আমার শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মো. আব্দুর রউফ আকুতি জানান— “স্মৃতি যেন কভু বিস্মৃত না হয় অবেলায় কোনো সাঁঝে/ চিরদিন ইহা স্মৃতি হয়ে থাক সবার হৃদয় মাঝে।” নবগ্রামের এই দু’টি (প্রগতি এবং স্মৃতি) প্রকাশনায় আমার জুনিয়র মো. আব্দুল ওয়াহিদ (মরহুম) এর সহযোগিতার কথাও স্মরণ করতে হয় কৃতজ্ঞ চিত্তে।
আমার কর্মযজ্ঞের অন্যতম একটি আনোয়ারা ফাউন্ডেশন। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এর অফিস আমি করতে চেয়েছিলাম নবগ্রামে। নানা কারণে তা আর হলো না। হলে নবগ্রামের সাথে আমার সম্পৃক্ততা আরো বাড়তো।
যাহোক, নবগ্রাম হাজী মো. ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা মিলে গঠন করেছেন— স্টুডেন্ট ফোরাম। খুবই ভালো কথা। আমার ধারণা, এ ফোরামের মাধ্যমে বিদ্যালয় ও নবগ্রামের অনেক উন্নয়ন সাধন হবে। সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও দায়িত্বশীলদের তাই অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি নিজে সরাসরি এ সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হতে না পারায় দু:খিত। নিয়মিত লেখালেখিসহ নিজের প্রচুর কাজের চাপ এর অন্যতম কারণ।
নবগ্রাম একটি ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ এলাকা। আশার কথা, এখানে অনেকদিন থেকে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখন দরকার কলেজ ও গার্লস স্কুল। আমি এদিকে নবগ্রামের দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি সবিনয় কামনা করছি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নবগ্রামের প্রবাসীরাও এলাকার প্রতি আন্তরিক। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এলাকাবাসীর প্রতি তারা যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েন, তেমনি এলাকার গরীব—দু:খীদেরও বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন দু’হাতে। মাদার বাজার সংলগ্ন বড়ভাগা’য় নির্মিত নবগ্রাম সেতু প্রবাসীদের ঐতিহাসিক অবদান। নি:সন্দেহে তা খুবই প্রশংসনীয়। এতদসত্বেও আমার মাঝে মাঝে মনে হয় নবগ্রাম এলাকাটা আরো আলোকিত হওয়া চাই। হঁ্যা জ্ঞান—বিজ্ঞান, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নবগ্রামবাসীর গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি চাই। এমন আলোকিত নবগ্রাম চাই, যেখানে কেউ অশিক্ষিত ও দারিদ্র্য সীমার নীচে থাকবে না। যেখানে সবাই সুখী—সুন্দর—স্বচ্ছল জীবন যাপন করবে। যোবায়েদা ভিলা, ২১ জুন ২০২৪
আব্দুর রশীদ লুলু: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক। আনোয়ারা হোমিও হল, দেওয়ান বাজার, গহরপুর, বালাগঞ্জ, সিলেট। মোবাঃ ০১৭১৮ ৫০৮৯৮০