অনলাইন ডেস্কঃ

প্রবাসীদের বলা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ প্রবাসীর পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থ তথা রেমিটেন্স এ দেশের অর্থনীতির চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে রাখছে অতুলনীয় ভূমিকা।

কিন্তু যারা দেশের অর্থনীতির প্রাণ, তাদের নিজেদের প্রাণের মূল্য যেন এখানে তুচ্ছ। দেশমাতৃকার টানে দেশে ফিরে অনেক প্রবাসী প্রাণ হারান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিতেই সুবিচার পাননি তাদের পরিবার। সবসময়ই পার পেয়ে যায় দায়ীরা। ফলে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে নিজ এলাকা- সবখানেই নিজেদের নিরাপত্তাহীন ভাবেন প্রবাসীরা।

১৯৯৬ সালের ৯ মে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের ৩৫ বছর বয়সী ছুরত মিয়া ওরফে সিরাজ মিয়া নাড়ির টানে যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেন দেশে। যুক্তরাজ্যর নিউক্যাসল থেকে বিমানে ঢাকা বিমানবন্দরে নামেন। সেখানে তার কাছে ঘুষ চান কাস্টসের এক নারী কর্মকর্তা। এর প্রতিবাদ করেন ছুরত মিয়া। তখন কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ, আন্দোলন গড়ে ওঠে দেশে-বিদেশে।

যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক নবাব উদ্দিন জানান, ছুরত মিয়া ৪ হাজার পাউন্ড নিয়ে দেশে গিয়েছিলেন। এ টাকা দেখেই ঘুষ চান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এতে খেপে যান ছুরত। কাঠ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ঘটনায় ৪ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিলেও ‘পর্যাপ্ত প্রমাণের’ অভাবে তারা মুক্তি পেয়ে যায়। ছুরতের পরিবার এখনও নিউকাসলে থাকেন।

বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ছুরত আলী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ক্ষত শুকানোর আগেই ২০০১ সালের জুন মাসে মুঘল কোরাইশি (২২) নামের সিলেটের এক যুবক যুক্তরাজ্য থেকে দেশে বেড়াতে আসেন। ছুটি কাটিয়ে যুক্তরাজ্যে ফেরার পথে সিলেট থেকে বিমানে ঢাকায় যান তিনি। সেখানে বিমানের তত্ত্বাবধানে তাকেসহ অন্যদের রাখা হয় হোটেলে। কিন্তু পরদিন তিনি আর বিমানবন্দরে পৌঁছাননি। তাকে ছাড়াই ছেড়ে যায় বিমানের ফ্লাইট। দু’দিন পর বিমানবন্দর থেকে ১০ মাইল দূরে পাওয়া যায় মুঘলের লাশ। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তার পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিতে তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। পরে খুন করা হয়।

 

যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক আহাদ চৌধুরী বাবু জানান, বিমানের তত্ত্বাবধানেই মুঘল কোরাইশিকে হোটেলে রাখা হয়েছিল। অথচ তাকে অপহরণ করে খুন করা হয়। ওই ঘটনায় বিমান অফিস ঘেরাও করে আন্দোলন হয়। কিন্তু মুঘলের পরিবার বিচার পায়নি।

 

২০১১ সালের ২৬ জুন যুক্তরাজ্যের রচড্যাল এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ তাহির আলী নিজের পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথে আসেন। কয়েকদিন পর নিজ বাসায় খুন হন তিনি। জমি সংক্রান্ত বিষয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনারও বিচার পাননি তাহির আলীর পরিবার। প্রবাসী সাংবাদিক কে এম তাহির জানান, বাসায় ঢুকে মুখোশধারীরা হত্যা করে তাহির আলীকে। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়। কিন্তু বিচার মিলেনি।

 

সুনামগঞ্জের পাটলি গ্রামের রেহানা বেগম নিজের স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই যুক্তরাজ্য থেকে দেশে বেড়াতে আসেন। ওই বছরের ২ আগস্ট ১২ বছর বয়সী সন্তানের সামনে তাকে ১৮ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। টাকা ও স্বর্ণের লোভে তার আত্মীয়দের চারজন এ ঘটনা ঘটায় বলে জানা যায়।

 

প্রবাসী সাংবাদিক নবাব উদ্দিন জানান, রেহানা বেগমের খুনের ঘটনা ছিল নৃশংস। ছোট্ট ছেলের সামনে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। ভয়ংকর সেই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে তার পরিবার। কিন্তু খুনের বিচারটুকু তারা পায়নি।

 

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীমঙ্গলের একটি রিহ্যাব সেন্টার থেকে উদ্ধার করা হয় জালাল উদ্দিন নামের এক ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণের লাশ। চিকিৎসার জন্য সেখানে ভর্তি করেছিলেন তার পরিবার। পেয়েছিলেন শরীরে অসংখ্য আঘাতে জর্জরিত লাশ।

এদিকে, প্রবাসীরা যাতে দেশে এসে হয়রানির শিকার না হন এ জন্য প্রবাসী সেলকে আরও কার্যকর করার কথা জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক প্রতিমন্ত্রী, সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি নিজেও একসময় যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছিলেন। তিনি বলেন- ‘প্রবাসীরা দেশের সম্পদ নিয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন। অনেক সময় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগেন। যে কারণে সিলেটে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে প্রবাসীকল্যাণ সেল আরও কার্যকর করা হবে। এছাড়া প্রবাসীরা আগে বিমানবন্দরে বেশি হয়রানির হতেন। সেটি এখন অনেকটা কমেছে। এরপরও বিমানবন্দরে কোনোভাবেই যাতে প্রবাসীদের হয়রানির না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।