[t4b-ticker]

সজীব দে

 

‘অদ্বৈত আচার্য গোসাঞি ত্রিজগতে ধন্য।
তারোধিক প্রিয় মোর কেহ নাহি অন্য
আপনে ঈশ্বর অংশ জগতের গুরু।…..
তার দেহ পূজা পাইলে কৃষ্ণ পূজা পায় ।।’
অদ্বৈতআচার্য সম্পর্কে শ্রীহট্টবাসী ও সংস্কৃতে ‘চৈতন্যচরিত্র’ রচিয়তা মুরারী গুপ্তকে বলেছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। যাঁর জন্য দিন-মাস-বছরের পর বছর কৃষ্ণ ভজন ও গঙ্গা বক্ষে দাঁড়িয়ে তুলসী-পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে মুক্তিদাতা মহামানবকে আহবান করেছিলেন অদ্বৈতআচার্য। প্রার্থনা জানাতেন, প্রভু, আর দেরি করো না, তাড়াতাড়ি এসো। মানুষ অধ:পাতের শেষ সীমায় পৌঁছেছে, তুমি ছাড়া তাদের উদ্ধারের পথ নেই। ‘সদাশিব সদানন্দ’ চিত্তে যোগ সাধনা করেন ‘সপ্তশত বৎসর’ (অদ্বৈতপ্রকাশ)।

‘যদি, গৌর না হ’ত তবে কি হইত’।
মা শচীদেবী’র নিমাই, পিতা জগন্নাথ মিশ্র’র বিশ্বম্ভর, সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আর ভক্তদের গৌর-গৌরাঙ্গ-গৌরহরি’র আবির্ভাব ঘটেছিল মধ্যযুগে সঙ্কটময়কালে। সেই সময় জাতি-বিদ্বেষ, অবিচার, শাসন, শোষণ, নিষ্পেষণ চলছিল। সেদিন যদি তিনি ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতি হাত বাড়িয়ে না দিতেন তাহলে হয়তো সনাতন ধর্মেরই বিলুপ্তি ঘটতো। সাম্যবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাঁর ধর্মে ছিল না জাতিভেদ। পরস্পরের প্রতি প্রেম স্থাপন করাই চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মূলভিত্তি। এখানে স্থান ছিল না এক জাতির প্রতি অপর জাতির বিদ্বেষ-অবিচার এবং এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের বিভেদ। জীবে দয়া, ঈশ্বরের ভক্তি ও ভক্তি উদ্দীপনের জন্য নাম সংকীর্তন এরই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্ম। মানবপ্রেমে তিনি চারিদিক জ্যোতির্ময়ী করে তুলেছিলেন। যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন অদ্বৈতআচার্য।

এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলাদেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন এককণ্ঠবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল? তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গহিল্লোল সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নূতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্র জনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নতুন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর- অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্রন্দনধ্বনি। বিজন কক্ষে বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া একটিমাত্র বিরহিণীর বৈঠকি কান্না নয়, প্রেমে আকুল হইয়া নীলাকাশের তলে দাঁড়াইয়া সমস্ত বিশ্বজগতের ক্রন্দনধ্বনি।’

গৌর আনা ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ ভরদ্বাজ গৌত্রীয় গৌতম ত্রিবেদী। তাঁর পুত্র ও পৌত্রের নাম ছিল বিভাকর ও ভাস্কর। ভাস্কর বল্লাল সেনের সভাপণ্ডিত ছিলেন। বৈদান্তিক ভাস্কর পন্ডিত থেকে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের গণনা শুরু হয়। ভাস্করের পুত্র সায়ন আচার্য ও পৌত্র আড়ো ওঝা (আরুণি)। আড়ো ওঝা নাড়ুলি গ্রামে বাস করতেন বলে নাড়িয়াল নামে পরিচিত হন। তাঁর বংশজাত শ্রীপতি লাউড়াধিপতির সভাপন্ডিত হয়ে লাউড়ে আসেন। (প্রাচীনকালে লাউড় প্রাগজ্যোতিষ/কামরূপের ভগদত্ত রাজার শাসনাধীন ছিল। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দিতে ছিল বিজয় মাণিক্যের অধীন।) এই বংশের প্রভাকর পুত্র নরসিংহ নাড়িয়াল রাজা গনেশের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর পরামর্শে রাজা গনেশ খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে (১৩৮৫ খ্রি.) গিয়াস উদ্দীন বাদশাহের পৌত্র দ্বিতীয় শামস উদ্দীনকে পরাজিত ও নিহত করে গৌর অধিকার করেন। নরসিংহ নাড়িয়াল প্রথমে বাস করতেন শান্তিপুরে। তিনি মধুমৈত্রকে নিজ কন্যা সম্প্রদান করায় বারেন্দ্র সমাজে ‘কাপ’ নামে মধ্যবর্তী এক শ্রেণীর উৎপত্তি হয়। এজন্য তিনি ব্রাহ্মণ সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। এরপর তিনি লাউড়ে এসে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর সাত পুত্রের মধ্যে বিদ্যাধর ছিলেন অন্যতম। বিদ্যাধরের পুত্র ছকড়ি। ছকড়ির পুত্র কুবের ও নীলাম্বর আচার্য্য ছিলেন অদ্বৈত আচার্য ও শচীদেবীর জনক। খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে লাউড়ের রাজা ছিলেন কাত্যায়ন গোত্রীয় ব্রাহ্মণ নৃপতি দিব্যসিংহ। রাজধানী ছিল লাউড়ের নবগ্রামে। কুবেরাচার্য লাউড়ের রাজার সভাপণ্ডিত/মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও ধর্মপরায়ণ। তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি নবদ্বীপ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। নবগ্রামের মহানন্দ বিপ্রের কন্যা নাভাদেবীর সাথে তাঁর পরিণয় হয়।

গৌড়িয়া বাদশাহে মারি গৌড়ে হৈইলা রাজা
যার কন্যা বিবাহে হয় কাপের উৎপত্তি
লাউড় প্রদেশে হয় যাহার বসতি
সেই বংশ উদ্দীপক শ্রীকুবেরাচার্য
রাজধানীতে ছিল তার দ্বার পন্ডিত কার্য
(অদ্বৈতপ্রকাশ)
অদ্বৈতাচার্যের জন্মের আগে কুবেরাচার্য/কুবের মিশ্র ও নাভাদেবীর ছয় পুত্র (শ্রীকান্ত, লক্ষ্মীকান্ত, হরিহরানন্দ, সদাশিব, কুশলদাস, কীর্তিচন্দ্র) ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। কিন্ত সকলেই অল্পকালের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দের মাঘী সপ্তমী তিথিতে কুবেরাচার্য ও নাভাদেবী পুত্র সন্তান লাভ করেন। নাম রাখা হয় কমলাক্ষ। পরবর্তীতে তিনি অদ্বৈতআচার্য নামে খ্যাত হন। অল্পবয়সেই তিনি প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। পাঠসঙ্গি ছিলেন রাজকুমার। কমলাক্ষ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। যে কোন বিষয় যত কঠিনই হোক না কেন, একবার পাঠ করলে তিনি আর ভুলতেন না। এজন্য সকলে তাঁকে  শ্রুতিধরও বলত। অল্পকালের মধ্যেই তিনি বিবিধ শাস্ত্রে সুশিক্ষিত হয়ে উঠেন। তাঁর নির্ভীক স্বভাব ও দুরন্তপনায় রাজপুত্রও ভীত হতেন। অধিকতর ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য বারোবছর বয়সে তিনি শান্তিপুরে যান। সেখানে পূর্ণবাটি বা ফুল্লবাটি গ্রামের শান্তুনু আচার্য’র নিকট তিনি নানাবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে মহাপণ্ডিত হন। কিছুকাল পর কুবেরাচার্যও রাজ কাজ পরিত্যাগ করে শান্তিপুরে চলে যান। সেখানে পিতার মৃত্যুর পর অদ্বৈতআচার্য পিন্ডদানের জন্য গয়ায় যান। পরবর্তিতে নানা তীর্থ ভ্রমণ করেন। সেই সময় মাধবেন্দ্র পুরী ও পদকর্তা দ্বিজ বিদ্যাপতির সাথে তাঁর সাক্ষৎ হয়। অদ্বৈত শ্রীমৎ স্বামী মাধবেন্দ্র পুরী মহারাজের শিষ্য হন। গুরুর মুখে ভাগবতের ভাষ্য শুনেই তিনি কন্ঠস্থ করেন। তাঁর এই অলৌকিক ক্ষমতা দেখে সকলে বিস্মিত হন। মাধবেন্দ্র পুরী কর্তৃক প্রেমভক্তির বীজ আগেই উপ্ত হয়, পরবতীর্তে অদ্বৈত স্পর্শে তা অঙ্কুরিত হয়। তাদের চেষ্ঠায় ভারত ভূমিতে ভক্তিধর্ম প্রচারের ভূমিকা প্রস্তুত হয়। কাশীতে সাক্ষাৎ ঘটে মহাভাগবতোত্তম সন্যাসী বিজয় পুরীর সাথে। মথুরা ও ব্রজধাম পরিক্রমাকালে অদ্বৈতাচার্য মদনমোহন বিগ্রহ আবিস্কার করেন ও একটি বটগাছের নিচে অভিষেক ও স্থাপন করেন। ঐ সময় যমুনাতীরে কৃষ্ণদাস নামে এক কিশোরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে ও তাঁর সেবায় তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। কৃষ্ণদাস পরবর্তিতে অদ্বৈতজীবন বিষয়ক নানা বিবরণ সংবলিত একটি করচা লিখে অদ্বৈত শিষ্য শ্রীনাথ আচার্যকে দেন। শ্রীনাথ আচার্যের কাছ থেকে সেই বিবরণ ও আরও নানা বিষয় অবগত হয়ে হরিচরণ দাস ‘অদ্বৈতমঙ্গল’ রচনা করেন। এসময় ‘বেদপঞ্চানন’ কমলাক্ষ রাঢ়দেশীয় দ্বিজ দ্বিগ্বিজয়ী শ্যামদসকে তর্ক ও বিচারে পরাজিত করে ‘অদ্বৈত’ নাম প্রাপ্ত হন। তীর্থ দর্শনের পর শান্তিপুরে এসে তিনি ভক্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যায় নিয়োজিত হন। অসামান্য আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেই সময় থেকেই তিনি ছিলেন বৈষ্ণব সমাজের নেতা।

“প্রভুর আবির্ভাব পূর্বে যত বৈষ্ণবগণ।
অদ্বৈত আচার্য স্থানে করেন গমণ
গীতা ভাগবত কহে আচার্য গোসাঞি।
জ্ঞান কর্ম নিন্দা করি ভক্তির লড়াই।”
(চৈতন্যচরিতামৃত)
ক্রমে ক্রমে অদ্বৈত আচার্যের নাম-যশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পুত্রকে রাজ্যভিষিক্ত করে একদিন লাউড় থেকে রাজা দিব্যসিংহ শান্তিপুরে এসে উপস্থিত হন। শক্তি উপাসনা ত্যাগ করে গ্রহণ করেন বৈষ্ণব ধর্ম। তাঁর কৃষ্ণ অনুরাগ দেখে আচার্য ‘কৃষ্ণদাস’ নাম দেন। ‘লাউড়িয়া কৃষ্ণদাস’ নামেও তিনি খ্যাত ছিলেন। নির্জন স্থানে কুটির নির্মাণ করে তিনি অদ্বৈতআচার্যের বাল্যকালের উপর গ্রন্থ রচনা করেন।  সংস্কৃত পুস্তকের নাম ছিল ‘অদ্বৈতবাল্যলীলাসূত্র’। যা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

অদ্বৈতআচার্য’র পিতা কুবেরাচার্য/কুবের মিশ্র বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাবাসের জন্য শান্তিপুরে এসেছিলেন। নবদ্বীপেও তাঁর বাড়ি ছিল। নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের বাড়িতে অদ্বৈত প্রভু ভক্তবৃন্দের সাথে মিলিত হয়ে ভক্তিচর্চা করতেন। অদ্বৈতাচার্যের ভক্তি সম্মিলনের কথা শুনে যবন হরিদাস আকৃষ্ট হয়ে শান্তিপুরে আসেন। ছয় মাস বয়সে তিনি পিতৃ-মাতৃহারা হয়েছিলেন। তখন প্রতিবেশী মুসলমান দম্পতি তাকে পালন করেন। সেজন্য তিনি ‘যবন হরিদাস’ নামে প্রসিদ্ধ। হরিনাম শুনলে তাঁর হৃদয় আকুল হয়ে উঠতো। নানাভাবে বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়েও না ফেরাতে পেরে পালক পিতা-মাতা হরিদাসকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। প্রতিদিন ৩ লক্ষ নাম জপ করতেন তিনি।

“ সই ! কেবা শুনাইল শ্যাম নাম?
কানের ভিতর দিয়া,
মরমে পশিল গো,
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
(চণ্ডিদাস)
অদ্বৈতপ্রভু তাকে ভক্তিশিক্ষা প্রদান করেন। তিনি তাঁর দীক্ষাগুরুও। হরিদাসকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়েও পিতার শ্রাদ্ধে তিনি হরিদাসকে ভোজন করান। সমাজপতিরা এতে প্রতিবাদ মুখর হলে নির্ভীক আচার্য বললেন, ‘ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিলেই ব্রাহ্মণ হয় না, যার ব্রাহ্মণ্য গুণ আছে কেবল তিনিই ব্রাহ্মণ।’ আচার্য হরিদাসকে যেরূপ সম্মান করতেন, তা হরিদাসের ভয়ের কারণ হয়ে উঠে। আচার্যকে হরিদাস বললেন,-
‘অলৌকিক আচার তোমার কহিতে ভয় পাই
সেই কৃপা করিবে যাতে তোমার রক্ষা হয়’
(চৈতন্যচরিতামৃত)
উত্তরে আচার্য বললেন, ‘তুমি খাইলে হয় কোটি ব্রাহ্মণ ভোজন।’

এই ঘটনার পর থেকে হরিদার আসিন হলেন ভক্তি-সম্মান-মর্যাদার আসনে। সেই সময়ে হরিদাসের সাথে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তর্কচূড়ামণি যদুনন্দন আচার্য অদ্বৈত আচার্যের নিকট কৃষ্ণমন্ত্র গ্রহণ করেন। শ্যামদাস, কৃষ্ণদাস, হরিদাস, শ্রীবাস পণ্ডিত, যদুনন্দনের উদ্যোগে নারায়ণপুরের নৃসিংহ ভাদুড়ীর কন্যা সীতা ও শ্রী দেবীর সাথে অদ্বৈত আচার্যের পরিণয় হয়। তখনও মহাপ্রভুর জন্ম হয়নি। এরপরই অদ্বৈত টোল খুলে বসেন নবদ্বীপে গিয়ে। আচার্য অগ্রসর হন কঠোর সাধনার পথে। তাঁর প্রধান সঙ্গী ছিলেন হরিদাস, যিনি বিভিন্ন স্থানে হরিনাম প্রচার করতেন।

“নাম সমাপিয়া করে ধর্মের প্রচার
অলৌকিক কার্য্য তার, লোকে চমৎকার”

পরবতীর্কালে শূদ্র রামানন্দের কাছে উপদেশ শুনিয়ে ব্রাহ্মণ্য-গর্বিত প্রদ্যুম্ন মিশ্রের গর্ব চূর্ণ করেন মহাপ্রভু। ‘সন্ন্যাসী পণ্ডিতদের করিত গর্বনাশ নীচ শূদ্র দ্বারা করে ধর্মের প্রকাশ’। (চৈতন্যচরিতামৃত)। হরিদাসের মৃত্যুর পর ভক্তেরা তাঁর পদোদক পান করেন। আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বলেছেন, “আমি তো ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় নই, বৈশ্যও নই, শূদ্রও নই। আমি ব্রহ্মচারী নই, বর্ণাশ্রমী বাণপ্রস্থ বা সন্ন্যাসীও নই। যিনি নিখিল পরমানন্দপরিপূর্ণ অমৃতসাগর স্বরূপ আমি সেই শ্রীকৃষ্ণেরই চরণকমলের দাসদাসানুদাস মাত্র।” নাহং বিপ্রো নচ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো নাহং বর্ণী নচ গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা কিন্তু প্রোদ্যন্ নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাকে গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দা সদাসানুদাসঃ\ (চৈতন্যচরিতামৃত)

১৪০৭ শকাব্দে অর্থাৎ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনী পূর্ণিমা (দোল পূর্ণিমা) তিথিতে আবির্ভূত হন নিমাই। তখন তাঁর বড় ভাই বিশ্বরূপ অদ্বৈতাচার্যের কাছে বিদ্যা শিক্ষা করছেন। পরবর্তীতে বিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ক্রমে পিতৃ বিয়োগ, বিবাহ, পুনবিবাহ, গয়াযাত্রা প্রভৃতি ঘটনার মধ্যে দিয়ে বিশ্বম্ভররের জীবনের চিত্রপট পরিবর্তিত হতে থাকে। মাঝে মধ্যে তিনি অদ্বৈত সম্মিলনে তাঁর প্রতিভার ছাপ রাখতে লাগলেন। অলৌকিক প্রতিভায় অদ্বৈতাচার্য চুম্বকের ন্যায় আকৃষ্ট হন। অদ্বৈতআচার্য বিশ্বম্ভরের শক্তির কথা প্রচার করতে থাকেন। ঈশ্বরপুরীও নবদ্বীপে এসে প্রভাবিত হন ও কৃষ্ণমন্ত্র দান করেন বিশ্বম্ভরকে। গয়া থেকে বিশ্বম্ভর ফিরলে অদ্বৈতসহ ভক্তগণ তাঁকে ‘স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্রনন্দন’ বলে সম্বোধন করেন। একদিন বিশ্বম্ভর গদাধর সহ ভক্তবৃন্দ নিয়ে অদ্বৈত মন্দিরে আসেন, তখন অদ্বৈতআচার্য তাঁর পূজা শুরু করেন। বিশ্বম্ভর সকলকে জানালেন, অদ্বৈতই তাঁর আশৈশব গুরু এবং আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎসস্বরূপ। তিনি কখনও অদ্বৈতপ্রভুকে নিজপদ স্পর্শ করতে দিতেন না। নিজেই জোরপূর্বক অদ্বৈতআচার্যের পদধুলি মস্তকে নিতেন। তবে গৌরাঙ্গ প্রভু ভাবাবিষ্ট হলে অদ্বৈতপ্রভু তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতেন। ক্রমে গৌরাঙ্গ ভাবজগতের উর্ধ্বে আরোহন করতে থাকেন। একবার চন্দ্র শেখর আচার্যের গৃহে নাটক হয়। রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিশ্বম্ভর আর শ্রীকৃষ্ণ হয়েছিলেন অদ্বৈতআচার্য।

অদ্বৈত প্রভুর নিকট বিশ্বম্ভর ছিলেন স্বয়ং ভগবান। আর নিজেকে দীনহীন ভক্ত মনে করতেন। বিশ্বম্ভর যখন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবান হন তখন তিনি দ্বিধা ও সংকোচে অস্থির হন। সেজন্য একদিন পরিকল্পনা করে শান্তিপুরে গিয়ে তিনি হঠাৎ বশিষ্ঠ রামায়নের ব্যাখ্যায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বললেন—
জ্ঞান বিনে কিবা শক্তি ধরে বিষ্ণুভক্তি ।…
‘বিষ্ণুভক্তি’ দর্পণ লোচন হয় ‘জ্ঞান’

এদিকে বহুদিন আচার্যের সাক্ষাৎ না পেয়ে বিশ্বম্ভর নিতানন্দ সহ সকলকে নিয়ে শান্তিপুরে গিয়ে দেখেন অদ্বৈতাচার্য জ্ঞানযোগ ব্যাখ্যা করছেন। শ্রীচৈতন্য তাঁকে প্রশ্ন করলেন- ‘বোল দেখি জ্ঞান ভক্তি হইতে কে বাড়া? অদ্বৈত বললেন, ‘সর্বকালেই জ্ঞান বড় হয়েছে। যার জ্ঞান নাই, ভক্তি তার কি করিবে। কথা শুনে বিশ্বম্ভর জ্ঞান শূন্য হন।
ক্রোধে বাহ্য পাশরিলা শ্রীশচীনন্দন
পিড়া ইইতে অদ্বৈতেরে ধরিয়া আনিয়া
স্বহস্তে কিলায় প্রভু উঠানে পাড়িয়া

ক্রোধে আত্মহারা বিশ্বম্ভর প্রহার করতে লাগলেন আচার্যকে। অদ্বৈত আনন্দে আত্মহারা হয়ে গৌরাঙ্গ গুণগান করলে তিনি সম্বিৎ ফিরে পান এবং লজ্জিত হন। কিন্তু তাদের লীলাখেলায় অন্যদিকে বিপর্যয় ঘটে যায়। কয়েকজন অদ্বৈত শিষ্য সত্যিই জ্ঞানবাদি হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে শঙ্করের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাদের নানাভাবে বুঝিয়ে বললেন,
মনোরথ সিদ্ধ মুই কৈনু এ প্রকারে
ছাড় ছাড় ওরে পাগলা ! নষ্ট হইলা।

কিন্তু তিনি শঙ্করকে তিনি আর জ্ঞানমার্গ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। শঙ্করাদি ভক্তবৃন্দকে তিনি বর্ণশঙ্কর আখ্যা দিয়ে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নবদ্বীপ লীলা শেষে গৌরাঙ্গ প্রভু কটোয়ায় গিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। কৌপীন সম্বল করে তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন। স্নান শেষে উপরে উঠে দেখেন অদ্বৈত প্রভু তাঁর জন্য নদীর তীরে কৌপীন-বর্হিবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আচার্য নিজ গৃহে নিয়ে যান চৈতন্যকে। একদিন চৈতন্য নীলাচলের পথে যাত্রা করেন। পথে দেখাশোনা করার জন্য নিত্যানন্দ, মুকুন্দ, জগদানন্দ ও দামোদর কে সঙ্গে পাঠিয়ে দেন আচার্য। এরপরই নদীয়ার চাঁদের হাট ভেঙে যায়। আচার্যও শান্তিপুরে চলে যান। তিন বছর পর মহাপ্রভু দক্ষিণাত্য পরিক্রমার শেষে নীলাচলে ফিরলে অদ্বৈতপ্রভু ভক্তবৃন্দ সাথে নিয়ে যাত্রা করেন। অদ্বৈতকে দেখেই তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন মহাপ্রভু। বললেন, ‘অদ্বৈতেরে প্রভু কহে বিনয় বচনে/আজি আমি পূর্ণ হৈলাম তোমার আগমনে’ আচার্য একদিন পুষ্প-তুলসী দিয়ে মহাপ্রভুর পূজা আরম্ব করেন। আচার্যকে কিছু বলতে না পেরে মহাপ্রভুও অদ্বৈতের পূজা করতে লাগলেন। এরপর অদ্বৈত আচার্য ভক্তদের জানালেন, চৈতন্যের কীর্তন গান করতে হবে। বললেন, ‘আজি আর কোন অবতার গাওয়া নাঞি/সর্ব অবতারময়-চৈতন্য গোসাঞি’ সম্ভবত চৈতন্যলীলা বিষয়ক সংগীতের জন্ম এখানেই। করলেন  কীর্তন, ‘শ্রীচৈতন্য নারায়ণ করুনাসাগর/দীন দুঃখিতের বন্ধু প্রভু মোরে দয়া কর।’ ভক্তরাও শ্রীচৈতন্যকে দেবত্বে অভিষিক্ত করে পূজা করতে থাকেন।  সেবার চারমাস পর অদ্বৈতপ্রভু ভক্তবৃন্দসহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। শেষ বয়সে বৃদ্ধ অদ্বৈতাচার্য পক্ষে বার বার নীলাচলে যাওয়া সম্ভব হতো না। জগদানন্দ মারফত অদ্বৈতপ্রভু একবার মহাপ্রভুর জন্য একটি তর্জা (প্রহেলিকা) বলে পাঠান।

বাউলকে কহিও লোকে হইল আউল
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল
বাউলকে কহিও ইহা কহিছে বাউল
অর্থাৎ মহাপ্রভুর কাজ শেষ হয়েছে, তাঁর আর কোন প্রয়োজন নেই। মহানন্দে আপনি নিত্য বৃন্দাবন ধামে চলে যান। ভক্তদের আগ্রহে শ্রীগৌরাঙ্গ বললেন, কী আশ্চর্য, আবাহন আর বিসর্জন করায় বড় পটু। সকল কথাই তাঁর বড় অলৌকিক, শ্রীকৃষ্ণকে ইনি সিদ্ধ করে নিয়েছেন। একমাত্র তিনিই এর অর্থ বুঝতে সক্ষম। মহাপ্রভু বলেছিলেন-
আগম শাস্ত্রের বিধি বিধানে কুশল
উপাসনা লাগি দেবেরে করে আরাধন।
পূজা লাগি কতকাল করে আরাধন
পূজা নির্বাহ হইলে পাছে করে বিসর্জন।
তরজার কিবা অর্থ না জানি তাঁর মন

এর কিছুকাল পর ১৪৫৫ শকাব্দে মহাপ্রভুর তিরোভাব ঘটে। ২৪ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে তিনি নবদ্বীপ ছেড়ে যান। পরবর্তী ছয় বছর তিনি শুধু তীর্থভ্রমণ করেছেন। জীবনের শেষ ১৮ বছর কাটিয়েছেন শ্রীক্ষেত্রে। ৪৮ বছর বয়সে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য অপ্রকট হলেও তাঁর জীবন মহাসিন্ধুর মতোই গভীর-সীমাহীন। সেসময় অদ্বৈত প্রভু প্রায় শতবর্ষবয়স্ক। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ও মনের বিকারে আচার্য বলতেন-
ক্ষণে ক্ষণে তার জারি জুরি মুহ্রি জানি।
কার ভাবে গৌর হৈলি কহ দেখি শুনি
ক্ষণে কহে নিমাঞি তুহুঁ রহ মোর ঘরে।
শচী মায়ের দুঃখ হৈব গেলে দেশান্তরে

নিত্যানন্দপ্রভুর তিরোভাব দিবসেও অদ্বৈতপ্রভু খড়দহে তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলেন। তিরোভাবের আগে অদ্বৈত আচার্য নিজ জন্মভূমি লাউড়ে গৌরাঙ্গের নাম প্রচারের জন্য ঈশান নাগরকে আদেশ দিয়েছিলেন। ঈশান প্রায় ৬১ বছর আচার্যের কাছে ছিলেন। ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে অদ্বৈত প্রভু অপ্রকট হন। অদ্বৈত পত্নী সীতাদেবী ঈশানকে পূর্বদেশে এসে বিবাহ করে গৃহাশ্রম অবলম্বন করার আদেশ দেন। ঈশান নাগর লাউড়ে বসেই আট বছরে গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন। ১৪৯০ শকাব্দে অর্থাৎ ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
চৌদ্দশত নবতি শকাব্দ পরিমাণে
লীলাগ্রন্থ সাঙ্গ কৈনু শ্রী লাউড় ধামে
(অদ্বৈতপ্রকাশ)

বাংলায় যারা অদ্বৈত আচার্য প্রভুর জীবনী লিখেছেন, ঈশান নাগর ছাড়া আর কেউই তার লীলা চাক্ষুষ দর্শন করতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সাথে আচার্যের গৃহে এসেছিলেন। সেদিন অদ্বৈতআচার্যের বড় ছেলে অচ্যুতনন্দ’র হাতে খড়ি হচ্ছিল। সেই থেকে প্রভু গৃহেই ছিলেন ঈশান। অদ্বৈতআচার্যের যত্নে ঈশান কালক্রমে পণ্ডিত হয়ে উঠেন।

পণাতীর্থ
বাল্যকালেই অদ্বৈত আচার্য পণাতীর্থের মহিমা প্রকাশ করেছিলেন। ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, একদিন রাত্রিতে অদ্বৈত প্রভুর জননী নাভাদেবী স্বপ্নে দর্শন করেন যে, তিনি নানা তীর্থ জলে স্নান করছেন। প্রভাতে ধর্মশীলা নাভাদেবী স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ও তীর্থ গমনের বিবিধ অসুবিধার বিষয় চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। এমন সময়ে পুত্র অদ্বৈতাচার্য সেখানে উপস্থিত হয়ে মাতার বিমর্ষতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মাতা তাঁকে স্বপ্ন দর্শনের কথা অবহিত করেন। মাকে বিষন্ন দেখে তিনি পণ করেন এই স্থানেই তাবৎ তীর্থের আবির্ভাব করাবেন। অদ্বৈতআচার্য মন:শক্তির অসীম প্রভাব ও যোগবলের অসাধারণ শক্তিতে তীর্থ সমূহকে আকর্ষণ করে লাউড়ের এক শৈলের উপর আনয়ন করেন। ঐ শৈল খণ্ডের একটি ঝরণাতীর্থবারি পরিপূরিত হয়ে ঝরঝর করে পড়তে লাগলো। অদ্বৈত জননী তাতে স্নান করে পরিতৃপ্তা হলেন। এইভাবে লাউড়ে এই তীর্থের উৎপত্তি হয়। অদ্বৈতের ন্যায় তীর্থ সমূহও পণ করেছিলো মধুকৃষ্ণা এয়োদশী যোগে তাঁদের আবির্ভাব হবে।

‘তদবধি পণাতীর্থ হৈল তার নাম
পণাবগাহনে সিদ্ধ হয় মনস্কাম’
(অদ্বৈত প্রকাশ)।
পণাতীর্থে বারুণী যোগে বহু লোকের সমাগম হয়। এই স্থানে স্নান করলে সকল তীর্থের ফল লাভ হয়। কালপ্রভাবে যখন লাউড় রাজ্য ধ্বংসমুখে পতিত হয়, তখন অদ্বৈত প্রভুর বাড়িও জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে। তখন অদ্বৈতাচার্যের জন্মস্থান লাউর পরগণার কোন অংশে অবস্থিত তা নির্ণয় করতে না পেরে ভক্ত এবং বৈষ্ণবগণ ক্ষুন্ন হতেন। আরম্ভ হয় অদ্বৈত আচার্যের জন্মস্থানের অনুসন্ধান। অদ্বৈত বংশোদ্ভব উথলিবাসী বৃন্দাবন চন্দ্র গোস্বামীর আদেশে সুনামগঞ্জের তহশীলদার শ্রীযুক্ত রুক্ষ্মিণীকান্ত আচার্য্য এই কাজে নিযুক্ত হন। এ জন্য তাঁকে হিংস্র জন্তুপূর্ণ কণ্টকাবৃত জঙ্গলে কতদিন ভ্রমণ করতে হয়েছে, কত নিশা জঙ্গলের গাছের নিচে অতিবাহিত করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি নিরুৎসাহ হননি, অধ্যবসায় ত্যাগ করেননি। ভক্তি বলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লাউড়ের জঙ্গল তন্ন তন্ন করে দেখেছেন। ১২৭৯ বঙ্গাব্দে তিনি প্রাচীন দীঘি, গৃহের ভগ্নাবশেষের চিহ্নের নিদর্শনে রাজবাড়ির স্থান চিহ্নিত করে উৎসাহিত হন। কিন্তু অভীষ্ট তখনও সিদ্ধ হয়নি। এরপর তাঁর কাছে ধরা দিলেন অদ্বৈত ধাম। সেই জনমানবহীন নিবিড় বনে তিনি শঙ্খ ও করতালের ধ্বনি শুনে বিস্মিত হন। অনেকেই তা ভৌতিক ব্যাপার বলে ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু তার মনে অন্য ধারণার জন্ম নেয়। একদিন প্রভাতে সেই দিকে ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে তিনি বের হন। রাজবাড়ির পাশে সেই গহন বনে একস্থানে অসংখ্য তুলসীবৃক্ষ বেষ্টিত অদ্বৈতাচার্যের বাড়ি ও বহু প্রাচীন মাধবীবেষ্টিত বিশাল আমগাছ সমন্বিত পুকুর দেখতে পান। এই স্থানই যে অদ্বৈত আচার্য’র জন্মস্থান তার স্বপক্ষে অনেক অকাট্য আধ্যাত্মিক প্রমাণও পাওয়া যায়। অদ্বৈতাচার্যের বাড়ির পাশ দিয়ে রেঙ্গুয়া (যাদুকাটা) নদী প্রবাহিত। নদী তীরেই ছিল রাজবাড়ি। সুনামগঞ্জের তদানীন্তন মুন্সেফ শ্রীযুক্ত নৃত্যগোপাল গোস্বামী ও পূবোর্ক্ত তহশীলদার শ্রীযুক্ত রুক্ষ্মিণীকান্ত আচার্যের বিশেষ উদ্যোগে গোকুল চন্দ্র দাস পুরকায়স্থ নবগ্রামে অদ্বৈতাচার্যের বাড়িতেই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অদ্বৈত আখড়া’ স্থাপন করেন। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে (মহাবারুণী) এখানে মেলা বসে। চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিকে বারুণী যোগ বলা হয়। যদি ত্রয়োদশী তিথির সঙ্গে শতভিষা নক্ষত্র যোগ হয়, তবে সেটাকে মহাবারুণী যোগ বলা হয়। ঐ পুণ্য দিনে দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়। বর্তমানে সেখানে কোনো প্রাচীন স্মৃতি নেই। যাদুকাটা নদীর পূর্বপাড়ে ভক্তবৃন্দের দ্বারা নির্মিত শ্রীঅদ্বৈত মন্দির রয়েছে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর