অনলাইন ডেস্কঃ
সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার (২৯ মে) বিকাল থেকে হঠাৎ করে এসব উপজেলায় হু হু করে বাড়তে শুরু করে পানি। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন পানিবন্দী মানুষজন।
অনেকেই নানাভাবে নানা জনের কাছে উদ্ধারের আকুতি জানান। এরকমই একজন জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা মো. সাজ্জাদুর রহমান সাজন। বুধবার রাতে পানি যখন বাড়ছিলো- উপায় না দেখে তিনি তার আম্মা ও ছোট ভাইকে ফ্রিজের উপর তুলে দিয়ে নিজে চৌকির উপর দাঁড়ান। পানি যখন তার নাক বরাবর চলে আসে তখন বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। সাহায্য চেয়ে আগে অনেকগুলো পোস্ট দেন ভার্চুয়াল মাধ্যম ফেসবুকে। তার শেষ পোস্টটি ছিলো- ‘লাশ উদ্ধার অইমু (হব) হয়তো, জীবিত উদ্ধার অইতে (হতে) পারতাম না…হয়তো এইটা শেষ পোস্ট।’
তবে তার পরিবারের সঙ্গে ঘটেনি কোনো অনাকঙ্খিত ঘটনা। মধ্যরাতে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন স্থানীয় কিছু লোক।
সাজন বললেন, ‘পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস যখন ব্যর্থ হয়েছে তখন এলাকার ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাঁচিয়েছেন।’
জানা গেছে, টানা বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে সিলেট জেলার পাঁচ উপজেলা বন্যাকবলিত। এর মধ্যে সবচেয়ে আক্রান্ত জৈন্তাপুর। উপজেলায় বুধবার রাতে নিজ ঘরে আটকা পড়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন সাজন ও তার পরিবার। এ সময় সাহায্য চেয়ে তিনি একের পর এক ফেসবুকে পোস্ট দিতে থাকেন। সেসব পোস্ট অনেকেই শেয়ার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন।
বুধবার (২৯ মে) রাত ৯টা ১৮ মিনিটে সাহায্য চেয়ে প্রথম পোস্টটি দেন সাজন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমি দৌলা চেয়ারম্যানের ভাতিজা, দিলু মিয়ার পোয়া (ছেলে) বাড়ি ফেরীঘাট, আমরারে কেউ বাঁচাও, আমরার মরণ সামনে কেউ বাঁচাও আমরারে। মা ভাই লইয়া আটকি গেছি (মা, ভাইসহ আটকা পড়েছি)।’
সাজনের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরত্বে ফেরিঘাট। প্রথম পোস্ট দেওয়ার পাঁচ মিনিট পর আক্ষেপ প্রকাশ করে দ্বিতীয় পোস্ট দেন, ‘হায়রে ফেরীঘাটের নৌকা, একটা নৌকা নাইনি বাছাইবার লাগি (একটা নৌকা নেই কি বাঁচানোর জন্য)।
‘রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে তৃতীয় পোস্টে তিনি বাঁচার আকুতি জানিয়ে লেখেন, ‘অনেক স্রোতের কারণে কেউ উদ্ধারের জন্য আসতে পারছে না, সুন্দর এই ভুবনে বাঁচার অনেক ইচ্ছা।’
এর ২৯ মিনিট পর লেখেন, ‘এখনো কেউ উদ্ধারে আইছে না (আসেনি)।’ এই পোস্টের কমেন্টে স্থানীয় অনেকে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা এসেছেন বলে জানান। এ সময় ইউএনও আসেন পরিবারটিকে উদ্ধার করতে।
শাকিল আহমদ নামের একজন ওই কমেন্ট বক্সে জানান, ব্রিজের পূর্ব পাশের নৌকা ব্রিজ পার হচ্ছে না, ফেরিঘাটের দক্ষিণের নৌকা প্রবল স্রোতের জন্য পার করা যাচ্ছে না। হরিপুর থেকে একটি নৌকা আসছে গাড়িতে করে।
শতাধিক কমেন্টে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রাত ১১টা ৮ মিনিটে সাজন জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে লেখেন, ‘লাশ উদ্ধার অইমু (হব) হয়তো, জীবিত উদ্ধার অইতে পারতাম না (হতে পারব না), হয়তো এইটা শেষ পোস্ট।’ তার এ পোস্ট কয়েক হাজার মানুষকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দেয়।
এদিকে, পাহাড়ি ঢলের জন্য তীব্র স্রোতের কারণে সাজন ও তার পরিবারকে উদ্ধারে যাওয়া যাচ্ছিল না। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ গিয়ে চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিল না। স্রোতের তীব্রতার কারণে কোনো নৌকা উদ্ধারে যেতে সাহস করছিল না। পরে স্থানীয় কয়েকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্ধারে যান। রাত দেড়টার দিকে তারা নৌকা নিয়ে ঘটনাস্থল পৌঁছতে সক্ষম হন।
রাত ১টা ৩৯ মিনিটে সাজন পোস্ট দেন ‘আলহামদুলিল্লাহ আমি আর আমার পরিবার উদ্ধার।’ সেখানে হাজারখানেক মানুষ স্বস্তির কথা জানিয়ে কমেন্ট করেন।
বুধবার রাতের ভয়াবহ পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে সাজন বলেন, ‘পানি বাড়ছে দেখে বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধের চেষ্টা করছিলাম বার বার। কিন্তু ওটা স্পর্শ করলেই বিদ্যুৎ ঝাঁকি দিচ্ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে একসময় আমার নাক পর্যন্ত যখন পানি চলে আসে তখন ধরেই নিয়েছিলাম মৃত্যু সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
২৩ বছর বয়সী সাজন জানান- তিনি স্থানীয় একটি কলেজে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। তার বাবা দিলু মিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে মারা যান। মা আর ১৫ বছর বয়সের ভাইকে নিয়ে তার সংসার।
সিলেটের জৈন্তাপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম (পিপিএম) বলেন, ‘রাতে আমরা খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে খেয়াঘাট এলাকায় যাই। কিন্তু পানির স্রোত এত তীব্র ছিল যে অনেক চেষ্টা করেও কোনো নৌকা বা মাঝি ম্যানেজ করা যায়নি। পরে স্থানীয়রা তার পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।’