[t4b-ticker]

অনলাইন ডেস্ক:

 

ঢেউ (আফাল) ঘরের ভিটার মাটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মাটিশূন্য ভিটার মাঝে বাঁশের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ঘর। কোনো ঘরের বেড়া ভেঙেছে, কোনোটার ভিটার মাটি সরে যাওয়ায় মাচা তৈরি করে বসবাস করছেন কেউ কেউ। বাড়ি ঘরে টিকতে না পেরে কেউ ছুটে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেছেন। তবে ঝুঁকি জেনেও ঘরে-বাইরে পানির মধ্যেই বেশিরভাগ রয়ে গেছেন ঘরে। ভোগান্তির মধ্যে লড়াই করছেন টিকে থাকার।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ৭ নম্বর তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওরপারের মুর্শিবাদকুরা, বড়ময়দান, দুর্গাই, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, শ্রীরামপুরসহ বেশির ভাগ গ্রামে ঘুরলে এখন এমন দৃশ্য চোখে পড়বে।

মুর্শিবাদকুরা গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া মুর্শিবাদকুরা গ্রামের খালেদা বেগম মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকালে বলেন, ‘বন্যায় বাড়ি-ঘর নিছেগি (ভাসিয়ে নিয়ে গেছে)। হুরুতাইন (ছেলে-মেয়ে) লইয়া খুব কষ্ট করি ইস্কুলে (স্কুলে) আইয়া (এসে) উঠছি (ওঠেছি)। বাড়ি ঘরের আর খবর নিতাম পারছি না। ৫ দিন ধরি আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। সরকারি সায্য (সাহায্য) তুরা পাইছি। কোনোমতে চলরাম।’

গতকাল তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নৌকা করে মুর্শিবাদকুরা গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে পানিবন্দী বাড়িগুলো। হাকালুকি হাওরের বুকে অথই জলের ভাসানে দূরে দূরে সবুজ রেখার মতো গ্রামগুলো যেন ভেসে আছে জলের বুকে। ঢেউয়ের পর পর এসে আছড়ে পড়ছে এসব বাড়িতে। স্থানীয়রা একে বলেন আফাল। বন্যায় হাওর পারের বাসিন্দারা এই আফাল (ঢেউ) আতঙ্কে থাকেন বেশি। ঝড়ের সময়, বাতাস হলে এবং হাওরে ইঞ্চিন নৌকা চলাচলের সময় হাওরে আফাল (ঢেউ) ওঠে। তখন বসতভিটা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায়, অনেক বাড়িরই ভিটে বাঁশ ও কচুরিপানা দিয়ে ঢেউ থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক ঘরের ভিটার মাটি হাওরের ঢেউয়ে ভেসে গেছে। মাটি ভেসে যাওয়ায় ঘরের তলা ফাঁকা হয়ে আছে। বাঁশের খুঁটির উপর টিনের চালা ও বেড়া দাঁড়িয়ে আছে।

 

মুর্শিবাদকুরা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব আছমা বেগম ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পানিবন্দী জীবনযাপন করছেন। তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। আছমা বেগম বলেন, ‘২০২২ সালের বন্যায়ও ঘরে ছিলাম। তাই এবারও ফেলে যাইনি। আমার প্রাপ্ত বয়স্ক দুটি মেয়ে আছে। গরু-বাছুর আছে ৫-৬টা। তাদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে থাকা খুব কষ্ট।’

আছমা বেগম আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘প্রায় ১০ দিন ধরে পানিবন্দী আছি, কিলা আছি কেউ খোঁজ নিছে না। গতবারও কোনো সাহাইয্য পাইলাম না। ইবারও (এবারও) পাইলাম। ই-কষ্টের কথা কারে কইতাম, কারে বুঝাইতাম।’

ঘরের আশপাশে আফাল (ঢেউ) থেকে বাঁচতে বাঁশ ও কচুরিপানা দিয়ে ঘর রক্ষার বিষয়টি দেখিয়ে আছমা বেগম বলেন, ‘দিন আমরার যেমন-তেমন কাটে। কিন্তু রাতে আমরা আতঙ্কে থাকি। ঘুম আসে না। রাতে আফাল উঠে বেশি। সাপের ডর (ভয়) তো আছে।’

একই এলাকার বাসিন্দা মৎস্যজীবী কামরুল ইসলাম। তিনি হাকালুকি হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবার নিয়ে বন্যায় ভেসে যাওয়া বাড়িতেই দিন পার করছেন। হাওরে মাছ শিকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কথা হয় তার সাথে।

গত শনিবার বিকেলে তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আগের বছরের (২২ সালের) বন্যার ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরমাঝে এবার আরও বড় ধাক্কা খেলাম। আফালে (ঢেউয়ে) ঘরের অনেক ক্ষতি করেছে। বন্যার সময় রাতের বেলা আফাল (ঢেউ) আর সাপের আতঙ্কটাই বেশি আমাদের থাকে। মাছ ধরে কোনো মতে আমি সংসার চালাই। ঘর ভাঙলে আমাদের মতো গরীব মানুষের জন্য ঠিক করা কত কষ্টের; এটা গরীব মানুষ ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।’

গ্রামের কামরুল ইসলামের ঘরসহ বেশকিছু ঘর দেখা গেল, বেড়া ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে। বেড়ার স্থান ফাঁকা হয়ে আছে। গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের আপ্তাব উদ্দিনের ঘরের ভিটের মাটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঢেউ। মাটিশূন্য ঘর দাঁড়িয়ে আছে বাঁশের খুঁটির ওপর। বাড়িতে ঠিকতে না পেরে তিনি (আপ্তাব উদ্দিন) পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন।

স্থানীয় লোকজন ক্ষোভ ও আক্ষেপের স্বরে বলেন, যারা আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন, তারা সহায়তা পাচ্ছেন। তবে আমরা যারা বাড়িতে আছি। কেউই সহযোগিতা পাচ্ছি না। ঠিকে থাকতে আমাদের আফালসহ (ঢেউ) নানা রকম লড়াই করতে হচ্ছে।

গত শনিবার বিকেলের দিকে হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আসা অনেকের সাথে কথা হয়। তাদের প্রায় সবারই কমবেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বড়ময়দান গ্রামের ফখর উদ্দিন বলেন, ‘বন্যায় ঘরে পানি উঠায় আশ্রয়কেন্দ্রে আইছি। এরপর একদিন গিয়া দেখছি ঘরর
অবস্থা নাই। আফালে ঘরর কুন্তা (কিচ্ছু) রাখছে না। ঘর ঠিক করতেই এখন অনেক টাকা লাগব।’

হাকালুকি হাওর থেকে ফেরার পথে তালিমপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজারে কথা হয় অনেকের সাথে। বাংলাবাজারের পুরোটাই জলমগ্ন। জরুরী প্রয়োজনে যারা বাজারে এসেছেন তাদের সবারই আসা-যাওয়ার পথ ও ঘরে পানি। একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রতিবার বন্যায় তাদের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবারও হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারি সাহায্য মেলেনি কোনোবারই।

বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর, দাসেরবাজার, সুজানগর, নিজবাহাদুরপুর, বর্নি, উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণভাগ উত্তর, দক্ষিণ ইউনিয়ন এবং বড়লেখা সদরে বন্যা আছে। গত ১৫ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত দুই-তিনদিন বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে হাওর পারের মানুষের ভোগান্তি কমার জন্য তা যথেষ্ট নয়। এবার বড়লেখায় বন্যায় প্রায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। এর মধ্যে ৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন প্রায় সাড়ে চারশতাধিক পারিবারের মানুষ। বানভাসি এসব মানুষ নিজেদের রক্ষার পাশাপাশি গৃহপালিত পশু রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত। মানুষের খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বানভাসি এলাকায় দেখা দিয়েছে পশুখাদ্যের তীব্র সংকট।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বড়লেখা উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নের ২৫২টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যাকবলিতদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৫০ টন চাল বরাদ্দের পাশাপাশি রান্না করা ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজরাতুন নাঈম বলেন, ‘আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। কোনো পানিবন্দি মানুষ যেন ত্রাণ সামগ্রী থেকে বাদ না পড়ে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। কেউ যেন নির্ধারিত পরিমাণ থেকে কম না পায়, সেটা সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, ট্যাগ অফিসার, সচিব, ইউপি সদস্য নিশ্চিত করবেন। কেউ যদি ত্রাণ বিতরণে কোনোধরনের অনিয়ম করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’